
আশরাফুল ইসলাম
ওদু ফকির দাবি করেন, দোয়াদাওয়া, ওষুধ ও আলো-বাতাসবিহীন ঘরে রেখে শিকল থেরাপি দিয়ে শতাধিক মানসিক রোগীকে তিনি সুস্থ করেছেন। তবে তাদের নাম-ঠিকানা তিনি জানাতে পারেননি।
গত শনিবার দুপুর ১২টায় সরেজমিনে দেখা গেছে, সুদর্শন এক তরুণকে মাটিতে বসিয়ে ব্লেড দিয়ে টাক করতে ব্যস্ত মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। ছেঁড়া একটি লুঙ্গি পরা ও খালি গায়ের ওই তরুণের দুই পায়ে শিকল লাগানো। পাশে মাথায় সাবান দিয়ে টাক করার অপেক্ষায় বসে আছেন আরেক তরুণ। এ সময় দরবারে উপস্থিত জীবননগর শহরের মাহবুবুর রহমান জানান, মাথা ন্যাড়ার কাজে ব্যস্ত ব্যক্তিই ওদু ফকির। যাঁর মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে, তিনি আশরাফুল ইসলাম মঞ্জু।
ওদু ফকিরের উপস্থিতিতে আশরাফুল এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের উত্তর আগ্রাবাদ এলাকায়। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে বিকম পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম সিডিএ ২০ নম্বর এলাকার রিদম গার্মেন্টসে চাকরি নেন। সেখানে কর্মরত অবস্থায় পরিচয় ঘটে কুমিল্লার নারিন্দা গ্রামের নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গে। পরিবারের অসম্মতিতে ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে বিয়ে করেন। পরিবারের সদস্যরা এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। বড় ভাই আমিরুল ইসলাম ও মেজো ভাই নজরুল ইসলাম মিলে তাঁকে মানসিক রোগী পরিচয় দিয়ে বিয়ের পরদিন ওদু ফকিরের আস্তানায় রেখে যান। আশরাফুলের দাবি, তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হওয়ার পরও ষড়যন্ত্র করে পাগল বানানোর চেষ্টা করেন পরিবারের সদস্যরা। বৃদ্ধ মা আয়েশা খাতুনের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল তাঁকে চুয়াডাঙ্গা থেকে চট্টগ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও বন্দী করে রাখা হয়। মাঝে কিছুদিন একটি মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্রে রেখেও নির্যাতন করা হয়। স্ত্রী নিলুফার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাঁকে আবারও গত ৪ এপ্রিল এখানে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে এখনো বন্দী জীবন যাপন করছেন।
যেখানে মানসিক রোগীদের রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেই বন্দিশালা দেখতে চাইলে ওদু ফকির নিজেই সেখানে নিয়ে যান। চার ফুট চওড়া ও ছয় ফুট লম্বা, চারদিকে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চাল দিয়ে তৈরি ওই ঘরে দেড় ফুট চওড়া ও দুই ফুট লম্বা টিনের দরজার একটি প্রবেশপথ রয়েছে। ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। প্রস্রাব-পায়খানা সারার জন্য রয়েছে একটি নালা।
আশরাফুল জানান, ২৪ ঘণ্টার প্রায় পুরো সময় তাঁকে ওই অন্ধকার ঘরে বন্দী রেখে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে গলা থেকে পায়ে একটি শিকল এবং দুই পায়ে আরেকটি শিকল পরিয়ে রাখা হয়। শিকল পরিয়ে রাখায় পায়ে ক্ষত হয়েছে। সকালে বাসিপচা ভাত আর দুপুরে আধপেটা খাবার দেওয়া হয়। গোসলের সুযোগ দেওয়া হয় একবার। রাতে কোনো খাবার দেওয়া হয় না। চুল কাটার জন্য শনিবার বাইরে বের না করলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁর দেখা হতো না বলে আশরাফুল জানান। তিনি বলেন, কারণে-অকারণে তাঁকে মারধর করা হয়। তিন বেলা ঘুমের ও পায়খানার ওষুধ খাওয়ানো হয়। যতক্ষণ জেগে থাকেন, শিকল পরেই পায়খানা করেন। আশরাফুলের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় তিনি মারা যেতে পারেন। প্রথম দিকে বিয়ের কারণে বন্দীশালায় পাঠালেও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর সম্পদ দখলে নিতে তাঁর ভাইবোনেরা তাঁকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বন্দীশালায় রাখা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে জানতে চাইল ওদু ফকির বলেন, তাঁর বাবা মরহুম রমজান আলী ফকিরের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এই চিকিৎসাব্যবস্থা পেয়েছেন। এতে শতাধিক মানসিক রোগী ভালো হয়েছে। তবে তাঁদের নাম-ঠিকানা জানাতে পারেননি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কয়েক দিন আগে এসে এই চিকিৎসাপদ্ধতি বন্ধের জন্য বলে গেছেন। কিন্তু আশরাফুলের বাড়িতে খবরের পর খবর দেওয়া হলেও কেউ তাঁকে নিতে আসছে না।
জানতে চাওয়া হলে আশরাফুলের বড় ভাই আমিরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আশরাফুল ২০০১ সাল থেকে মানসিক রোগী।
পরিবারের অনিচ্ছায় বিয়ে করায় এবং তাঁর সম্পত্তি দখলের জন্য পাগল বানানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে কি না জানতে চাইলে আমিরুল বলেন, সম্পদ দখলের ইচ্ছা থাকলে কখনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো না।
জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান জানান, মানসিক প্রতিবন্ধী এক তরুণকে চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। এর বেশি কিছু জানেন না।
জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন কামরুল হুদা বলেন, মানসিক রোগী চিকিৎসার নামে এ ধরনের অপচিকিৎসা দেওয়া ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া দরকার।




৬:৩৯ PM
Akashnill
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন