রবিবার, ১৯ জুন, ২০১১

একটি ভুয়া বিয়ে ও তিনটি ভ্রূণ হত্যা



undefined
সীমাকে বিয়ের নাম করে প্রায় চার বছর সংসার করে ছেলেটি। এর মধ্যে তিনবার গর্ভবতী হলেও মা হতে পারেনি মেয়েটি। জোর করে গর্ভপাত করতে বাধ্য করা হয়। ছেলেটি অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। সীমা প্রতিবাদ করলে তাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তার দুঃসহ জীবন নিয়ে এখন সে কী করবে, কোথায় যাবে?

সীমা একজন পোশাকশ্রমিক। গত ১৫ দিন হলো চাকরিতে যেতে পারছে না। এই কয়টা দিন মেয়েটি ভীষণ অস্থির দিন কাটাচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে এর-ওর কাছে। পুলিশের কাছে, উকিলের কাছে। আবার কারও কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে। সব জায়গা থেকেই বলা হয়, পত্রিকার লোকদের সঙ্গে দেখা করতে। কথামতো হাজির প্রথম আলো কার্যালয়ে। মেয়েটির সঙ্গে কথা হয় দীর্ঘক্ষণ।
কী বিষয়ে জানতে চাইলে সহজ-সরল দুই চোখ দিয়ে বইতে লাগল জলের জোয়ার। খুব সাদাসিধে মিষ্টি মেয়েটিকে দেখেই মায়া লাগল। ভেজা ও কাঁপা গলায় বলতে লাগল তার কাহিনি। মেয়েটির মা-বাবা বেঁচে নেই। সাত বছর বয়সে বাবাকে হারায়। এর কিছুদিন পর মাও মারা যান। ভাইবোন কেউ নেই। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর নানির কাছেই বড় হয়েছে।
কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। মেয়েটির বয়স যখন ১৬ কি ১৭; তখন কাজের জন্য আসে নারায়ণগঞ্জ। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়। কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে একটি বাসা ভাড়া নেয়। কিছুদিন পর ওই বাড়িওয়ালার এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। মেয়েটির ভাষায়, ‘ছেলের মিষ্টি আর আবেগি কথায় আমি গইল্যা পড়ি।’ তারপর দিন কাটতে থাকে। কয়েক মাস পার হতে না হতেই মেয়েটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখায়। মা-বাবার আদরবিহীন বেড়ে ওঠা মেয়েটির চোখে স্বপ্ন দোলা দেয়। বউ হওয়ার স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। প্রায় চার বছর আগে কোনো এক ফাগুনের দিনে ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে যায় তার বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে একজন মৌলভির মতো লোক ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয়। সাদা একটা কাগজে স্বাক্ষর দেয় দুজন। এরপর চলতে থাকে দুজনের নতুন জীবন। কিন্তু কয়েক মাস পার হতে না হতেই ছেলেটি বদলে যেতে থাকে। নিজের বাসায় ওঠানোর কথা বলে দিন কাটাতে থাকে। এমন করে কেটে যায় প্রায় এক বছর। তারপর একদিন জানাজানি হয় সবকিছু। ছেলেটির মা-বাবা জেনে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে। ছেলেটি তাকে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া করে দেয়। কিন্তু কোনো ভরণপোষণ বা ভাড়ার টাকাটাও দেয় না। মাঝেমধ্যে এসে শুধু রাত কাটিয়ে যায় মেয়েটির সঙ্গে। এভাবে কাটে আরও কয়েক মাস। মেয়েটির কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে সব। ছেলেটির সঙ্গে আরও অনেক মেয়ের সম্পর্ক আছে, সেটা সে প্রমাণ পায়। ছেলেটির বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলাও করে একটি মেয়ে। কিন্তু ছেলেটি তো তার স্বামী, তাই সব মুখ বুজে সহ্য করে যায়। মেয়েটিকে একদিন পাশের বাসার এক মহিলা জিজ্ঞেস করে, ‘বিয়ে যে হইছে কাবিননামা লাগে। কত টাকা দেনমোহর ছিল। কোন কাজি অফিসে হয়েছে’ ইত্যাদি। এসব শুনে মেয়েটি ছেলেটিকে কাবিনের বিষয় জিজ্ঞেস করে। তখন ছেলেটি এ বিষয় এড়িয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তখনো সীমা বুঝতে পারেনি বিয়েতে কোনো কাবিনই হয়নি। ভুয়া কাজি এনে এমনিতেই সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। তবুও দিন কাটতে থাকে এভাবেই। এর মধ্যে তিনবার গর্ভবতী হয় সীমা। কিন্তু মা আর হতে পারল না মেয়েটি। প্রতিবারই বাচ্চা পেটে এসেছে শুনে ছেলেটি জোর করে সীমাকে নিয়ে গর্ভপাত করিয়েছে। জানতে পারি, দুটি ভ্রূণ দুই মাস বয়সে এবং একটি তিন মাস বয়সেই গর্ভপাত করতে হয় তাকে। মেয়েটি গর্ভপাতের সব ডাক্তারি কাগজপত্র দেখায়।
জিজ্ঞেস করি, এভাবে যে আপনাকে মা হতে দিল না, আপনি বাধা দেননি কেন? ‘বাধা তো দিছি। কিন্তু হেয় আমারে জোর কইরা লইয়্যা যাইত। আমারে মারধর করত রাজি না হইলে। তাই বাধ্য হইছিলাম।’
বিয়ের কাবিননামার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে, বিয়েটা তার কীভাবে হলো। বুঝতে আর বাকি রইল না যে বিয়ে করার নামে প্রতারণা করা হয়েছে মেয়েটির সঙ্গে। তাকে বলি, আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনাকে সে ভুয়া বিবাহ করেছে?
‘হ, এনে তো সূর্যের আলোর লাহান আমার কাছে পরিষ্কার হইয়া গেছে সবকিছু। আমারে হে বিয়ার নাম কইরা, আমার সর্বনাশ কইরা যাইত খালি।’
মেয়েটি কান্না করতে করতে বলতে থাকে, কয়েক দিন আগে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করে ছেলেটি। ওটা শোনার পর সীমা প্রতিবাদ করে। তখন ছেলেটি অস্বীকার করে সীমা তার বউ। ‘আমি নাহি হের বউ না। হে কয়, আমি নাহি মিথ্যা কই, হেরে ফাঁসানোর লাইগ্যা। ভাই, আপনিই কন, হেরে কেন ফাঁসাইতে যাইমু। হেরে তো আমি স্বামী মানছি। আমি খালি হের স্বীকৃতি চাই। হেরে তো ভালোবাইসা বিয়া করছিলাম। হেরে অন্ধের মতোন বিশ্বাস করছিলাম। কিন্তু বিয়ার সময় যে কাবিন করে নাই, আর ভুয়া কাজি দিয়া বিয়া পড়াইছে, হেইডা তো বুঝবার পারি নাই। আমি এহন কী করুম...?’
মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, আপনি কি কোনো আইনের আশ্রয় নিতে চান?
‘আমি তো পুলিশের কাছে, উকিলের কাছে গেছিলাম। কিন্তু হেরা কয় যে পত্রিকাতে আইতে। তাই আইলাম।’
একটি মানবাধিকার সংগঠনের ঠিকানা দিয়ে যোগাযোগ করতে বললাম। কথামতো মেয়েটি ওই সংগঠনে গেল। ফোনে বলল, ‘ভাই, আমারে একটা কূল-কিনারা কইর‌্যা দেন। আমার ওপরে খোদা আর নিচে আপনারা ছাড়া কেউ নাই এই দুইনাতে। আমার কোনো হানে যাওনের জায়গা নাই...।’
ভাবতে থাকি, মেয়েটি এখন কী করে প্রমাণ করবে যে লোকটার স্ত্রী। আদালত তো প্রমাণ চায়। সীমা এখন কোথায়ই বা যাবে। ছেলেটি মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করছে। নেই কোনো প্রমাণ, নেই কাবিননামা। চার বছর ধরে একটি অবৈধ সম্পর্কের ফাঁদে আটকে ছিল মেয়েটি। এর সুরাহা কী? কীভাবে মিলবে এর প্রতিকার? রয়েছে গর্ভপাত করানোর প্রমাণপত্র। পারিবারিক আদালতে যদি দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মোকদ্দমা করে, তাহলে কী হবে? অথবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কি এর প্রতিকার আছে? ছেলেটির বিরুদ্ধে কি ধর্ষণের অভিযোগ আনা যাবে? দণ্ডবিধির ৩১৩ ধারা অনুযায়ী কি অবৈধ গর্ভপাত করানোর মামলা করা যাবে, যেখানে দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হতে পারে ১০ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা। দণ্ডবিধির ৪৯৩ ও ৪৯৬ ধারায়ও প্রতিকারের সুযোগ আছে।
তাহলে প্রমাণ মিলবে কী করে! কিন্তু আইন আদালতের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে তো অসহায় মেয়েটি—নানা প্রশ্ন, নানা শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা ভর করতে থাকে মেয়েটির জন্য...।
পাদটীকা: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের বেশি কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভয়ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে যৌন সঙ্গম করে, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। আর ১৬ বছরের কম বয়সী নারীর সঙ্গে সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। ধর্ষণের অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৪৯৬ ধারা অনুযায়ি আইনসম্মত বিয়ে না করে প্রতারনামূলক বিয়ে করলে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
tanzimlaw@yahoo.com
প্রথম আলো

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons