'ভয়ংকর নেশা' উত্তেজক ওষুধে ঝুঁকছে যুবসমাজ। গোপনে চলছে আমদানি ও বিপণন নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধের বিজ্ঞাপন-বাণিজ্য। চোরাপথে দেশের বাজারে আসছে এসব ওষুধ। বিক্রি হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যেই। বিক্রেতারা এসব ওষুধকে 'পাওয়ার' বলে অভিহিত করছেন। এসব পাওয়ারের মধ্যে 'ইয়াবা' নিয়ে দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলেও অন্যান্য ওষুধ নিয়ে নেই তৎপরতা। এসব ওষুধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু অভিযান চালালেও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। 'যৌন উত্তেজক' বলে প্রচার করা অনুমোদনহীন দেশীয় ওষুধের বাজারও বাড়ছে। তবে স্বাস্থ্য ও মাদকবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ওষুধ এক ধরনের মাদক। আসক্তি বাড়ানো ওষুধগুলো শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা ও সারা দেশের খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা রাজধানীর মিটফোর্ড, বাবুবাজার ও চানখাঁরপুল থেকে দেশি-বিদেশি উত্তেজক ওষুধ কিনে এলাকায় চড়া দামে বিক্রি করছেন। খুচরা বিক্রেতারা এসব ওষুধকে পাওয়ার বলে ডাকেন। অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে তাঁরা পাওয়ারও নিয়ে নেন প্রয়োজনমতো। শাহবাগ, মতিঝিল, ধানমণ্ডি, মিরপুর রোড, শেরে বাংলানগরসহ সবখানেই পাওয়ার খুচরা বিক্রি হচ্ছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মিটফোর্ডের কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতা জানান, সরদার মার্কেটকে বলা হয় ইন্ডিয়ান মার্কেট। এ মার্কেটের নিচতলার দোকানগুলোতেই পাওয়ার ওষুধ বেশি বিকিকিনি হয়। এ ছাড়া হাবিব মার্কেটসহ সব মার্কেটে এখন উত্তেজক ওষুধ বিক্রি হয়। রাজধানীর অভিজাত এলাকার ওষুধের দোকানেই বিক্রি বেশি। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর যুবক-যুবতীরা এসব ওষুধ খাচ্ছে। কিছু উত্তেজক ওষুধ খেলে চেহারার লাবণ্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এ কারণে শখ করে খায় অনেকে। উত্তেজনার পাশাপাশি নেশার কারণে ইয়াবা বেশি প্রচলিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, ইন্টাগ্রা, কেজি প্লাসসহ বিভিন্ন ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়েছে যুবসমাজ। এক শ্রেণীর অপচিকৎসায় এ ধরনের ওষুধের মাধ্যমে যৌন দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা চালানো হয়। ওই সব কথিত চিকিৎসক এ ধরনের ওষুধ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটেও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিক্রেতারা জানান, ভারতের তৈরি 'ইন্টাগ্রা' ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। আমেরিকার ভায়াগ্রার প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৭৫০ টাকা। ভারতের সেনেগ্রা ও কামাগ্রা প্রতি ট্যাবলেট ৫০ থেকে ৭০ টাকা। সেনেগ্রা, টেনেগ্রা, ফরজেস্ট, ক্যাবেটরা, টার্গেট ও ইডেগ্রা বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা। অধিকাংশ ওষুধের গায়ে মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ লেখা থাকে না। আমেরিকার টাইটানিক এক বোতলের দাম চার হাজার টাকা। খুচরা ট্যাবলেট ৪০০ টাকা। টাইটানিকে ইয়াবার মতো উত্তেজনার পাশাপাশি নেশা হয়। তাই ইয়াবার ক্রেতারা কেউ কেউ টাইটানিক সেবন করছেন। কম দামে পাওয়া যাচ্ছে চীনের জিয়ংবার। একটি ট্যাবলেটের দাম ৭০ টাকা। কেজি প্লাস (ইউএসএ) কৌটা ৫০০ টাকা। জে হরমালিন ৭৫০ টাকা। কস্তুরি গোল্ড ৫২০ টাকা। পাকিস্তানি ফরজেস্ট-২০-এর মূল্য ৩৫০ টাকা। জিনসিন প্লাস ৯০০ টাকার বঙ্ েবিক্রি হয়। পাওয়া যাচ্ছে দেশে তৈরি উত্তেজক ওষুধও। বিভিন্ন কম্পানির নিশাত, নিশাত সিলভার, লিভিজ্ঞা, এনডিউরেঙ্, লিপিডেঙ্, ডিউরেঙ্, বাইটোলেঙ্, ফ্রুডেঙ্ ও চায়না গোল্ড নামের ওষুধগুলো বিক্রি হচ্ছে দেদার।
মাদকের তালিকায় নেই : ইয়াবা, আইসপিলসহ সব ধরনের পাওয়ার বা উত্তেজক ওষুধ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদকের তালিকায় নেই। ফলে ক্ষতিকর ওষুধগুলো থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা মেট্রোপলিটন উপ-অঞ্চল) মজিবুর রহমান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ইয়াবায় ব্যবহৃত হয় কাঁচামাল মিথাইল অ্যামফিটামিন ও অ্যামফিটামিন। এই অ্যামফিটামিনকেই আলাদা করে আইসপিল বলে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া অন্য উত্তেজক ওষুধগুলোয়ও এ রকম মাদকের উপাদান ব্যবহার করা হতে পারে। তবে ওই সব ওষুধ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পরীক্ষা করে দেখেছে কি না তা জানাতে পারেননি তিনি।
ক্ষতিকর স্বাস্থ্যের জন্য : উত্তেজক ওষুধে আসক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে কৌতূহলেই খাওয়া শুরু করেন তাঁরা। ভালো লাগা থেকে এখন আসক্তি ও নেশা। কেউ কেউ বিশেষ শারীরিক ক্ষমতা বাড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করেন। পরে ওষুধ না খেলে তাঁরা স্বস্তি পান না। তবে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, উপযুক্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ধরনের উত্তেজক ওষুধ সেবন করা ঠিক নয়। এতে শরীরের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম এন হুদা জানান, পুরুষ-মহিলাদের মধ্যে ২ থেকে ৫ শতাংশের দুর্বলতা থাকতে পারে। ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশের মানসিক সমস্যা। সে জন্য বিভ্রান্ত হয়ে উত্তেজক ওষুধ খায় অনেকে। এসব ওষুধ হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়। এতে লিভার ও নার্ভ ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
আসছে যেভাবে : অনুসন্ধানে জানা যায়, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধ দেশে আসছে। বিমানবন্দরে প্রায়ই ধরা পড়ে এ ধরনের বড় চালান। অভিযোগ আছে, পাচারকারীদের সঙ্গে সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত আছেন। তাই মূল হোতারা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৯ জুলাই হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন লাগেজ আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধ আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। তবে লাগেজ বহনকারী সন্দেহভাজন পাকিস্তানি নাগরিক পালিয়ে যায়। ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর কাস্টমস প্রায় সোয়া কোটি টাকার আমদানি-নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধ আটক করে। তবে রহস্যজনকভাবে ওষুধ পাচারকারী চক্রের কাউকেই আটক করতে পারেনি কাস্টমস। চারটি লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে পাকিস্তানে তৈরি ২৩ ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন জব্দ করা হয়। সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সকালে কার্গো ভিলেজে পড়ে থাকা পাঁচটি বড় কার্টন কাস্টমস কর্মকর্তারা গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতিতে খুলে দেখেন কয়েক হাজার পিস উত্তেজক ওষুধ। এ চালান আনা হয় ভুয়া একটি গার্মেন্টের নামে। এর সঙ্গে জড়িত সিদ্দিক নামের এক পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
জানা গেছে, কঙ্বাজার, উখিয়া, টেকনাফ এবং উত্তরাঞ্চলের ভারতের সীমান্ত হয়ে ইয়াবার সঙ্গে উত্তেজক ওষুধের চালান আসছে দেশে। গত ২১ মে চাঁদপুর শহরের লঞ্চঘাট এলাকা থেকে ভারতে তৈরি আট হাজার উত্তেজক ট্যাবলেটসহ রফিক খন্দকার ও শাহাদাত হোসেন নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় থানার পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, কুমিল্লা সীমান্ত থেকে এসব উত্তেজক ট্যাবলেট কিনে বিক্রির জন্য চাঁদপুরের লঞ্চঘাট হয়ে রফিক ও শাহাদাত নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল।
কার্যকর অভিযান নেই : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, মাদক হিসেবে নয়, আমদানি ও বিপণন-নিষিদ্ধ ওষুধ হিসেবেই উত্তেজক ওষুধ উদ্ধার করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুলিশ ও র্যাবের কিছু বড় অভিযান চললেও পরে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরে ইয়াবার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ অভিযান চালানো হচ্ছে, এর তুলনায় অন্য ওষুধের ক্ষেত্রে অভিযান খুবই কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ প্রশাসন ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৎপরতার অভাবে নিয়মিত অভিযান নেই।
র্যাবের গণমাধ্যম ও আইন বিভাগের তথ্যে জানা যায়, ইয়াবার পাশাপাশি উত্তেজক ওষুধও আটক করছে র্যাব। ২০১০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এই সময়ে পাঁচ হাজার ৯২ পিস আইসপিল উদ্ধার করেছে র্যাব। ভায়াগ্রা আটক করেছে ১৫ হাজার ১৫২ পিস। নিষিদ্ধ আরো বিভিন্ন ধরনের উত্তেজক ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার পিস।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোথায়, কিভাবে এসব ওষুধ বিক্রি হয় তা খতিয়ে দেখার জন্য আলাদা প্রশাসন কাজ করছে। তবে ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। এসব ওষুধ ভেজাল বা অনুমোদনহীন বলেই এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যায়।'
ওষুধ প্রশাসনের তৎপরতা নেই : মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী আবুল কাসেম জানান, ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অভিযানের অভাবেই এসব ওষুধ বিক্রি হয়। ডাক্তাররা এসব ওষুধ নিতে ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন, তাই অনেকে দোকানে নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধ রাখেন। এমন বক্তব্য আরো অনেক ব্যবসায়ীর। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিদেশি আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধের আদলে এখন দেশি কম্পানি উত্তেজক ওষুধ বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে। ওষুধ প্রশাসন ওই সব ওষুধের অনুমোদনও দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কিছু ব্যবসায়ী প্রকাশ্যেই উত্তেজক ওষুধ বিক্রি করেন। তাঁরা প্রভাবশালী। প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই মিটফোর্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় নীতিমালা অমান্য করে ওষুধ বিক্রি হয়। এসব বিষয়ে প্রশাসন ভূমিকা না রাখলে আমাদের কিছু করার থাকে না।' তবে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল সংকটের কারণে এসব ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। সারা দেশে মাত্র ২৮ জন কর্মকর্তা আছেন ওষুধ প্রশাসনের। তাই মনিটরিং করাও দুষ্কর।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, উত্তেজক ওষুধ হিসেবে যেসব ওষুধ বাজারে বিক্রি হয় তা ভেজাল এবং অনুমোদনহীন। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেরা তৈরি করে বিদেশি সিল লাগিয়ে দিচ্ছেন। দেশি কোনো কম্পানিকেও এ জাতীয় ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ক্ষতিকর সব উপাদান আছে। তিনি আরো বলেন, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির সুপারিশ এবং লোকবল বাড়ানো হলে অভিযান জোরদার করা হবে। কালের কন্ঠ




৫:৩১ PM
মম
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন