বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১১

দারাদের প্রতারণা সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব

জাপানি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজুও আজুমা
জাপানি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজুও আজুমা
আমি কেইকো আজুমা, জাপানের একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজুও আজুমার স্ত্রী। সিলেটে বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে দারাদ আহমেদ নামের এক বাংলাদেশি নাগরিকের দ্বারা আমরা প্রতারিত হয়েছি। প্রথম আলোর সহযোগিতায় আমাদের এত দিনের ভ্রান্তি কাটল। আমরা এখন দারাদের কাছ থেকে চুরি হওয়া বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধার এবং তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব বাংলাদেশির সহযোগিতা কামনা করছি। 
দারাদ অনেক বছর ধরে আমার স্বামী ও আমাকে ঠকিয়েছে। এতে আমরা যে কত মর্মাহত হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমার স্বামী এখন খুবই অসুস্থ। তাঁর মনের অবস্থা চিন্তা করে বড় দুঃখ পাই।
দারাদ আহমেদ আমাদের কাছে অনেকবার টাকা চেয়েছিল। প্রথমে সিলেটে বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমি কেনার নামে তিন কোটি জাপানি ইয়েন (দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা) জোগাড় করার জন্য বলেছিল। এরপর ভবন নির্মাণ বাবদ এক কোটি ৭০ লাখ ইয়েন (এক কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা) চেয়েছিল। আবার নির্মাণের খরচ অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি হওয়ার কথা বলে আমার ননদের কাছে দেড় কোটি ইয়েন (এক কোটি ৩৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা) নিয়েছিল। এতেও শেষ হয়নি। বাড়ির ভেতরের বিভিন্ন সরঞ্জামের জন্য সে বারবার টাকা চাওয়ায় আমরা অতিরিক্ত আরও ৪৮ লাখ ইয়েন (৪৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা) জোগাড় করে তাকে দিয়েছিলাম। সর্বশেষ সে আমাদের কাছ থেকে ১৮ লাখ ৫০ হাজার ইয়েন (১৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা) ধার হিসেবে নিতে চেয়েছিল। এভাবে আমরা মোট ছয় কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ইয়েন (ছয় কোটি ২৪ লাখ টাকা) তার হাতে দিয়েছিলাম আমাদের স্বপ্নের সাংস্কৃতিক বিনিময়কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, তার সেই কথা বিশ্বাস করে।
আমার স্বামী ও আমি কত কষ্ট করে এত টাকা জোগাড় করেছি, দারাদ কি সেটা বুঝতে পারে? আমাদের নিজের টাকা সব খরচ করে শেষ পর্যন্ত আমরা অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে তাকে দিয়েছি, সে কথা তার জানা ছিল কি? দারাদ আহমেদকে বিশ্বাস করেই আমরা তাকে এত বড় অঙ্কের টাকা দিয়েছি। তার সঙ্গে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছিলাম আমরা দুজন। শান্তিনিকেতনে নিপ্পন ভবন এবং কলকাতায় ভারত-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করার পর আমার স্বামীর আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশেও দুই দেশের সংস্কৃতি বিনিময়ের জন্য অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তবে শেষ পর্যন্ত দারাদের হাতে প্রতারিত হয়ে ঠকে গিয়ে এত দুর্দশা ভোগ করতে হবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি।
এত দিন সে যে কথা আমাদের শুনিয়েছে, তার সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, কেন্দ্রটির কিছুই হচ্ছে না। কতবার সে বলেছিল, ভবনটির উদ্বোধন হবে এবং তাতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেবেন। সব মিথ্যা কথা। কোনো একটি মসজিদের ছবি পাঠিয়ে একসময় সে জানাল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ছবি এটা। আমাদের বোকা বানানোর জন্য সে এমনকি মসজিদ পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে। দারাদ আবার একসময় বলেছিল, তার মা জাতিসংঘের চিকিৎসক। কিন্তু আমরা জানতে পারলাম, তিনি একজন সাধারণ গৃহিণী। নিজের মাকে এ ধরনের নিন্দনীয় কাজে লাগানো মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব কি? আমরা জানতে পেরেছি, দারাদের কথা আগাগোড়া মিথ্যা। ভাবতে অবাক লাগে, তার মতো এ রকম চূড়ান্ত অসৎ লোকও মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে জন্ম নিতে পারে!
আমরা তার কাছে দাবি করছি, আমাদের টাকা সে যেন ফিরিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে তার ভাইপো বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া এক লোক লন্ডন থেকে আমাকে টেলিফোন করে জানিয়েছে, কেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে সিলেটে যে জমি কেনা হয়েছে, এর দাম এখন বেড়ে গেছে এবং সেই জমি বিক্রি করে দারাদ আহমেদ আমাদের টাকা ফেরত দিতে চায়। ভালো কথা। শিগগিরই জমি বিক্রি করা হোক এবং টাকাটা আমাদের পাঠানো হোক। আমরা সেই টাকা দিয়ে বাংলাদেশে আসল জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বিনিময়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করব। দারাদের কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা তাতে একেবারেই থাকবে না। তার একমাত্র করণীয়, এখন কেবল আমাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া।
সিলেটে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার আমাদের পরিকল্পনায় সাড়া দিয়ে জাপানে ১০০ জনের মতো টাকা দান করেছেন। তাঁরা সবাই এখন দারাদের ওপর ক্ষুব্ধ। তবে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে আসল কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নতুনভাবে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি একা কিছুই করতে পারতাম না, তবে অনেকেই আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা সম্প্রতি চিঠি পাঠিয়েছি এবং আমাদের চলতি কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য জোর অনুরোধ তাঁকে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমার স্বামীকে ভালো করেই চেনেন। তাই আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ অচিরেই গ্রহণ করবেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা নিয়ে এই ঘটনার সমাধান করতে এবং বাংলাদেশে আমাদের দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির ঘাঁটি হিসেবে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এদিকে আমরা ইতিমধ্যে জাপানি পুলিশের কাছে মামলা করেছি এবং তারা সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ তদন্ত শুরু করেছে।
দারাদ আহমেদ এখন যেখানেই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের আইন সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক তৎপরতায় অল্প দিনের মধ্যে সে ধরা পড়বে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সঙ্গে আমি আরও বিশ্বাস করি যে জাপানের প্রতি বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের মানুষ দুই দেশের মৈত্রীর সম্পর্কের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জঘন্য ধরনের প্রতারণায় লিপ্ত সেই ব্যক্তিকে একঘরে করবেন। সর্বশক্তিমান তাকে যেন যথাযথ শাস্তি দেন—সেটাই আমাদের কামনা।
টোকিও, জাপান, ১২ জুলাই, ২০১১
কেইকো আজুমা: জাপানি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজুও আজুমার স্ত্রী।
প্রথম আলো

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons