রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০১১

মুম্বাই গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন বসতপুরের অনেক নারী

ভারতের মুম্বাইয়ের এক পানশালায় এক বছর কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন শানু। সঙ্গে কিছু টাকা, আর শরীরে নির্যাতনের ক্ষত। বাড়িতে পা দিয়েই তিন বছরের সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন কী নির্মম সময় পেরিয়ে এসেছেন তিনি।
শানুর মুম্বাইয়ের জীবন সম্পর্কে তাঁর মামা আকরাম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওর বাবার ক্যানসার ধরা পড়িসিলো। ভাতই যাদের জোটে না, তাদের আবার চিকিৎসা কী? কিন্তু শানু তাঁর আব্বার চিকিস্যা করাবেই। সেই জন্য সে বোম্বে গেল। তিন হাজার টাকা দালালেরে দিয়েসে। পরে শুনিসি শানুরে আটকায়ে রেখে বর্ডারে নির্যাতন করছে দালালেরা। বর্ডার পেরোবার পর এক বছরের চুক্তিতে তারে কাজ করতে হয়েছে এক বারে।’
যেমন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিলেন, তেমন কাঁদতে কাঁদতেই আবার একদিন দেশ ছাড়লেন শানু। যশোর সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী বসতপুর গ্রামের মেয়েটির কোথায় ঠাঁই হলো, সে খোঁজ কেউ রাখেনি। বাবা মারা গেছেন, স্বামী নিরুদ্দেশ। এখন মাঝেমধ্যে কিছু টাকা আসে বাড়িতে। তাতে পরিবারের লোকজন বুঝে নেয়, শানু বেঁচে আছে।
শার্শা উপজেলার বসতপুর ও এর আশপাশের গ্রামের ঠিক কত মেয়ে মুম্বাই গেছেন, তার হিসাব নেই সীমান্তরক্ষী বাহিনী কিংবা নারী পাচার নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের কাছে। গ্রামের কয়েক ব্যক্তি বললেন, তাঁরা খোঁজখবর করার আর চেষ্টাই করেন না। গ্রামের প্রায় ৯০০ পরিবারের মধ্যে মুম্বাইতে কেউ থাকেন না—এমন ১০০ পরিবারও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁদের কাছে ‘বোম্বে’ এখন দূরের কোনো অচেনা শহর নয়, পাশের বাড়ি, বড়জোর কয়েক ক্রোশ দূরের কোনো গ্রামের নাম। এদের কেউ জেনে-শুনে শুধু একটু ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই যাচ্ছেন, কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিচ্ছেন।
এত ঝুঁকি নিয়ে নারীরা কেন মুম্বাই যাচ্ছেন—এমন প্রশ্নে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আলী আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গিরামের মানুষের আসল সমস্যা হলো অভাব। ইখান থেকে বোম্বেতে ইনকাম সোর্স বেশি। দিন চলতি হলি ২০০ টাকা লাগে। এই বদ্ধ গিরামে কে কাকে এত টাকা দেবে? সেই ’৯২ সাল থিকেই মেয়েরা যাচ্ছে।’
কাগজের বউ: ১৫ বছর ধরে নারী পাচারের কাজ করছেন আমান। বললেন, ‘ধরেন গে, অনেক মেয়ে আছে পরিচয় নিয়ে যেতে চায়। সে ক্ষেত্রে একটা বিয়ের ফলস কাগজ করলিই হলো। এই আমিই তো ৮১টা বে (বিয়ে) করেছি। বউ বলে দেখিয়ে সোজা চলে যাই। তারপর বোম্বেতে বছর খানেকের চুক্তিতে কারও হাতে দিয়ে দিই।’
মুম্বাইফেরত একজন নারী জানান, মাস ছয়েক আগে তিনি এক দালালের সঙ্গে সীমান্তে যান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর এ পারের দালাল তাঁকে ওপারে পাঠিয়ে দেন। ওপার থেকে একজন ট্রেনে তুলে দেন। তিন দিন পর তিনি মুম্বাইতে পৌঁছান। কপাল খারাপ হলে বর্ডারে মারধর খেতে হয় বলেও তিনি জানান।
মুম্বাইতে এত স্বাচ্ছন্দ্য, তার পরও কেন ফিরে এসেছেন—এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আড়াই বছরের বাচ্চা। শুধু কান্নাকাটি করে।’
কোথায় কাজ করছে বাংলাদেশের মেয়েরা, জানতে চাইলে দালাল আমান নিউ মুম্বাই, ওয়াশি, সানপাড়া, জুঁইনগর, নেরুল, বেলপাড়া, খান্ডেশ্বর, পানমেলের নাম উল্লেখ করেন। যশোরের শার্শা এলাকার অধিবাসীরা সাধারণত শালকোনা, শিকারপুর, বেনাপোল, গগা, চান্দরিয়া, পুটখালী, বাহাদুরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের বনগাঁ, কুরুলিয়া, জয়ন্তীপুর, হরিদাসপুর, ঝাউডাঙ্গা, আংরাইলে পৌঁছান।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা: যশোরে ২২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার হাসিব আলম তাঁদের নজরদারি এড়িয়ে মানব পাচারের কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ আসলে যাচ্ছে পেটের দায়ে।
কখনো কখনো নারীদের উদ্ধার করে বিজিবি ফিরিয়ে এনেছে বলে দাবি করেন তিনি। এমন একজন যশোরের কৃষ্ণপুর গ্রামের মেয়ে বীথি। এক দালাল তাঁকে ফুসলে বেঙ্গালুরু নিয়ে যান। দুই বছর যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করেন। গত বছর চেন্নাইতে তাঁর অবস্থানের কথা জানতে পেরে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় ‘রাইটস যশোর’ নামের একটি সংগঠন। এতে সহযোগিতা করে বিজিবি।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয়কৃষ্ণ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ফিরে আসছেন তাঁদের কেউ কেউ পুনর্বাসনের পরও আবার মুম্বাই গেছেন। যদিও তাঁদের আয়ের ওপর পরিবারগুলো নির্ভরশীল, কিন্তু মুম্বাইফেরত নারীদের সমাজ গ্রহণ করছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই অনেকে বাধ্য হয়ে মুম্বাই যাচ্ছেন।
শুধু মামলা নয়, কাজ দরকার: বসতপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব লিচু বেগমও মুম্বাই গিয়েছিলেন ২০ বছর আগে। ইট ভাঙার কাজ করেছেন। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর নিরুপায় হয়ে তিনি মুম্বাই যান। এখন ছেলে ও ছেলের বউ মুম্বাই থাকে। তারা টাকা পাঠায়। তিনি বলেন, ‘বাঁচতে হলে কাজ চাই, টাকা চাই। শুধু মুম্বাই যাওয়া বন্ধ করলে চলবে কী করে?’
যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাভেদ আহমেদ বলেন, পাচার বন্ধে তাঁরা নারীদের ক্ষমতায়নের কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons