
গত রোববার বেলা তিনটা। ফার্মগেট বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) একটি টিকিট কাউন্টার। সরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত আবদুল মতিন মতিঝিল যাওয়ার জন্য ১০ টাকার একটি টিকিট কিনে দেখেন গায়ে লেখা ‘ভলভো বাস সেবা’। কিন্তু বাসে উঠতে গিয়ে দেখেন ভলভো নয়, চীনের তৈরি বাসের জন্য এই টিকিট দেওয়া হয়েছে। টিকিট বিক্রেতার কাছে কারণ জানতে চাইলে বলেন, ভলভো দ্বিতল বাস আর যাত্রী পরিবহন করে না।
টিকিট বিক্রেতার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রায় ৬১ কোটি টাকায় কেনা বিআরটিসির ৫০টি ভলভো বাসের ৪০টিই এখন পুরোপুরি অকেজো। অচল বাসগুলো গাজীপুরে সংস্থার মেরামত কারখানায় পড়ে আছে। বাকি ১০টি বাস কিছুটা সচল হলেও সেগুলো দিয়ে সাধারণ যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে না। ‘স্টাফ বাস’ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
ভলভো বাসগুলোর ন্যূনতম বয়সসীমা ১৫ বছর নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নয় বছরের মধ্যেই প্রায় সব বাস অকেজো হয়ে গেছে। বিআরটিসি সূত্র জানায়, কিছু বাস পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই মেরামত কারখানায় যায়।
ভলভোর পতন: সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) আর্থিক সহায়তায় সুইডেন থেকে ভলভো বাসগুলো আমদানি করা হয় ২০০২ সালে। সিডা, ভলভো বাসের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সুইডিস মোটরস ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে, রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতির কারণেই বাসগুলো অল্প সময়ের মধ্যে অকেজো হয়ে গেছে। বিআরটিসির একটি সূত্র জানায়, সব সরকারের আমলেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিআরটিসির কর্মকর্তারা নতুন বাস কেনার প্রকল্প নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন। ‘কমিশন বাণিজ্যের’ কারণে নতুন বাস কেনার পেছনে ছুটতে গিয়ে পুরোনো বাস আর মেরামত হয় না। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই বাসগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। ভলভো বাসের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
২০০৮ সালে বিভিন্ন সময় ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা প্রায় দেড় শ অকেজো বাসের তালিকা করে সেগুলো নিলামে বিক্রি করার উদ্যোগ নেয় বিআরটিসি। সেই বাসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বাসের বয়স পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে ছিল। তবে তখন ভলভো নিলামে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিআরটিসির উপমহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মেজর কাজী শফিক উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি অকেজো ভলভো বাস মেরামতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। সরকারি অনুদান না পাওয়া গেলে এই বাস মেরামত করা যাবে না। অর্থায়নের চেষ্টা চলছে। তিনি দাবি করেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় এবং যন্ত্রাংশের দাম বেশি হওয়ার কারণে এই সেবাটি চালু রাখা যাচ্ছে না।
বিআরটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, চীন থেকে নতুন বাস কেনা হয়েছে ৩৩ লাখ টাকায়। নতুন বাস কেনার সময় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটিতে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে ভলভো বাস মেরামতে আগ্রহ নেই কারও। ওই কর্মকর্তা বলেন, ধরে নেওয়া যায়, এই সেবাটির ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, ৪০টি অকেজো বাসের ১৭টি ২০০৮ সাল থেকে চলে না। ২০০৯ সালে এসে অকেজো বাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪-এ। গত দেড় বছরের ব্যবধানে বাকি বাসগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। সূত্র জানায়, গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে ভলভো বাসগুলো আস্তে আস্তে রাস্তা থেকে উঠে যায়।
শুরু থেকে ভলভো বাসের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সুইডিস মোটরস থেকে নেওয়া হতো। বিগত জোট সরকারের আমল থেকে বাকিতে যন্ত্রাংশ কেনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিআরটিসির কাছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা পাওনা হয়। জোট সরকার এ টাকা পরিশোধ না করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলে সুইডিস মোটরস যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
যেভাবে শুরু: শুরু থেকেই ভলভো বাসগুলো রাজধানীর মতিঝিল-মিরপুর ও মতিঝিল-আবদুল্লাহপুর পথে চলাচল শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যেই এই সেবাটি জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রথম আওয়ামী লীগের সরকার ভলভো বাস কেনার প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডা ৬১ কোটি টাকার অর্ধেক সাহায্য এবং বাকি অর্ধেক সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দেয়। প্রতিটি বাস এক কোটি তিন লাখ টাকা হিসেবে ৫০টি বাস কেনায় ব্যয় হয় প্রায় ৫২ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে নেওয়া ঢাকা নগর পরিবহন উন্নয়ন প্রকল্পে রাজধানীর যানজট নিরসনে বড় এবং দ্বিতল বাস বেশি করে নামানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এর আলোকে ২০০২-০৪ সালের মধ্যে সুইডেন থেকে ৫০টি ভলভো এবং ভারত থেকে ২০৫টি আশোক লিল্যান্ড দ্বিতল বাস নামানো হয়। ভলভো দ্বিতল বাসে মোট আসন ১২০টি। শুরুতে বলা হয়, আসনের অতিরিক্ত আরও ৪০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারবে। একটি ভলভো বাসে পাঁচটি মিনিবাসের সমান যাত্রী বহন করা সম্ভব।
সিডার মূল্যায়ন: সিডা ২০০৪ সালে ৫০টি ভলভো বাসের ওপর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভলভো বাসের শতকরা ৯০ ভাগ সচল ছিল, যা ইউরোপীয় মানদণ্ডের চেয়েও বেশি। চালুর কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বাস পুড়িয়ে দেওয়ায় সচলতার হার কিছুটা কম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভলভো বাসগুলো ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার চলেছে। ১৯৯৯ সালে যখন এই প্রকল্পটি নেওয়া হয় তখন প্রতিটি বাস বছরে ছয় হাজার কিলোমিটার চালানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে সময় প্রতি বাসে বছরে সাত লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বাসে বছরে যাত্রী পরিবহন করা হয় তিন লাখ ১৪ হাজার ৮০০।




১২:১০ PM
Akashnill
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন