কত পানি থাকে মানুষের চোখে? গণপিটুনিতে নিহত কলেজছাত্র কান্তর মা ও বোন সইবে কেমন করে এই বুকভাঙা শোক!ছবি: সাজিদ হোসেন
আবার ‘ডাকাত পিটিয়ে মারার’ অভিযোগে পুলিশ পাঁচ-ছয় শ গ্রামবাসীকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছে। এই মামলায় নিহতদের কাছ থেকে কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার দেখানো হয়।
নিহতদের স্বজনেরা বলছেন, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল পুলিশের সাজানো। তারা সবাই ছাত্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, ডাকাত নয়। গতকাল এলাকাবাসী ও বালুর ব্যবসা কেন্দ্রের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ডাকাতি মামলার বিবরণের সঙ্গে বাস্তবতার কিছু অমিল পাওয়া গেছে।
গত রোববার রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামবাসী ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে। এর পর থেকে বড়দেশী গ্রামের অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
এদিকে আহতাবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়া তাদের বন্ধু আল আমিন একই মামলায় গ্রেপ্তারের পর রাতে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। গণপিটুনিতে গুরুতর আহতাবস্থায় বেঁচে যায় সে। সোমবার রাত ও গতকাল সকালের মধ্যেই নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকায় শোক ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
ডাকাতি মামলা: ডাকাতি মামলার এজাহারে বাদী আবদুল মালেক অভিযোগ করেন, ‘রোববার রাত সোয়া একটার দিকে ১৫-২০ জনের সশস্ত্র ডাকাতদের একটি দল রামদা, ছোরা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ট্রলারযোগে আসে। তারা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শাহাদাত এন্টারপ্রাইজে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ক্যাশবাক্সে থাকা নগদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যায়। আমি বাধা দিতে গেলে একজন ডাকাত আমাকে মারধর করে জখম করে। এদের একজন মোটাসোটা গড়নের, হালকা দাড়ি আছে এবং একজন হালকা-পাতলা গড়নের।’
এজাহারে বলা হয়, ‘ডাকাতেরা আমার এখানে ডাকাতি করে পার্শ্ববর্তী আবদুল হামিদের গদিঘরে (ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ) ডাকাতির জন্য গেলে হামিদ ডাকাত ডাকাত চিৎকার করলে এলাকার লোকজন টের পায়। এরপর তারা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে কিছু ডাকাত ট্রলারযোগে পালিয়ে যায়। উত্তেজিত জনতা সাতজন ডাকাতকে ধরে গণপিটুনি দেয়। ফলে ছয়জন অজ্ঞাতনামা ডাকাত মারা যায়। একজন ডাকাত গুরুতর আহত হয়। পুলিশ সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত ডাকাতকে চিকিৎসার জন্য সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায়।’
মামলায় বলা হয়, ছয় ডাকাতের লাশ সুরতহাল শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডাকাতদের বয়স অনুমান ২০ থেকে ৩৫। কিছু ডাকাতের মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল। দু-তিনজনের পরনে হাফপ্যান্ট, পায়জামা, জিন্সের প্যান্ট ও লুঙ্গি ছিল। ডাকাতেরা বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তারা সোয়া একটা থেকে একটা ২৫ মিনিট পর্যন্ত ডাকাতি করে।
হত্যা মামলা ও অস্ত্র উদ্ধার: সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় বলা হয় ‘রাত দুইটা ৫ মিনিটে থানা থেকে বেতার মারফত জানা যায় যে বড়দেশী গ্রামে একদল ডাকাত ঢুকেছে। এসআই হারেস শিকদার ও ফোর্সসহ রাত আড়াইটার দিকে বড়দেশী গ্রামে ক্যাবলার চর উপস্থিত হয়ে দেখতে পাই, পাঁচ-ছয় শ উত্তেজিত জনতার মাঝে ছয় ডাকাতের মৃতদেহ পড়ে আছে। আহত অবস্থায় একজন ডাকাতকে পেয়ে চিকিৎসার জন্য সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাই। ডাকাতি করতে এসে উত্তেজিত জনতা গণপিটুনি দিলে অজ্ঞাতনামা ছয় ডাকাত মারা যায়। ঘটনাস্থল থেকে দুটি রামদা, একটি চাপাতি, তিনটি ছোরা ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।’
বাস্তবতা: গতকাল এলাকাবাসী ও বালু ব্যবসা কেন্দ্রের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার রাতে শবে বরাতের ইবাদতের জন্য ওই এলাকার বালু ব্যবসাকেন্দ্রগুলো (গদি) সব বন্ধ ছিল। শাহাদাত এন্টারপ্রাইজ, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজসহ আশপাশের কোনো গদিই খোলা ছিল না।
এ বিষয়ে বাদী আবদুল মালেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনে বা বাসায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাসায় কথা হয় মালেকের ভাই খালেকের সঙ্গে। খালেক বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজে ৪০ হাজার টাকা ডাকাতি হয়। তাই সবকিছু ঠিক আছে কি না, তা দেখতে আমার ভাই রাতে গদির দিক গেলে তিনি ডাকাতদের কবলে পড়েন। রাত দেড়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
এদিকে ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ থেকে জানানো হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটির আট মালিকের মধ্যে হামিদ একজন। শুক্রবার রাতে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন মালিক ঈমান আলীর উপস্থিতিতে সেখান থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকাসহ ড্রেজারের কিছু যন্ত্রাংশ লুট করে নিয়ে যায় ডাকাত। রোববার রাতে সেখানে কোনো ডাকাতি হয়নি।
নিহতদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধুরা বলেছেন, এ রকম একটা জায়গায় রামদা, ছুরি নিয়ে তাদের ডাকাতি করতে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। পুলিশ মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস: রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের একটি অনুষ্ঠানে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, সরকার আমিনবাজারে ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্ত করবে। দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। সরকার চায় না, মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিক।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, আমিনবাজারের ঘটনা দুঃখজনক। তবে এ ঘটনা দিয়ে সারা দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। আমিনবাজার একটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। এ ধরনের এলাকার অপরাধ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ওই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।
নিন্দা: এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এভাবে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা একদিকে যেমন নির্মম, অন্যদিকে তা আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের অনাস্থার পরিচায়ক। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না।
এ ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে তেজগাঁও কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি এবং শ্যামলী এলাকাবাসী। ঘটনার প্রতিবাদে দারুস সালাম এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
প্রথম আলো




৫:১২ PM
Akashnill
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন