আমিনবাজারে নিহত কলেজছাত্র ইব্রাহীমের জন্মবৃত্তান্ত উল্লেখ করে নিজের হাতে সুঁই-সুতার কাজ করে এই ফ্রেমটি বাঁধিয়েছিলেন তাঁর মা। এটি পড়ে আছে তাঁর পড়ার টেবিলেছবি: প্রথম আলো
বাঁধাই করা সূচিকর্মটি ইব্রাহিমদের শোবার ঘরের দেয়ালে ঝুলছে। নিচেই এলোমেলো হয়ে থাকা গতকালের পত্রিকাগুলো, যেগুলোতে ছাপা হয়েছে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর।
পাশে বিছানার ওপর বসে ওগুলো দেখতে দেখতে ইব্রাহিমের মা কখনো বিলাপ করছেন, কখনো বা ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠছেন। বারবার বলছেন, ‘আমার পোলাডা ডাকাইত না, কোন পাষাণে ওরে অ্যামনে মারল।’ ইব্রাহিমের চাচা আবদুল মালেক সেটি দেখিয়ে বললেন, ‘মায় জন্মবৃত্তান্ত লিখল, আর আপনারা মৃত্যুর খবর ছাপালেন।’
আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামে গত রোববার রাতে গ্রামবাসীর পিটুনিতে নিহত ছয় ছাত্রের পরিবারগুলোতে এখন বিলাপ ছাপিয়ে দানা বাঁধছে ক্ষোভ। কিন্তু করণীয় জানে না কেউই। তাই স্বজনদের কেউ চিৎকার করে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে, কেউ বা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ছয় তরুণের মধ্যে তিনজনের বাসা দারুস সালাম এলাকায় আর তিনজনের শ্যামলীতে। এই দুই এলাকার মানুষের মধ্যেই তীব্র ক্ষোভ। ক্ষোভ ছিল নিহত ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঙলা কলেজ ও তেজগাঁও কলেজেও। সিতাব জাবির মুনীব হত্যার বিচার দাবিতে মিরপুরে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্ররা।
ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে দারুস সালাম এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন করেছে এলাকাবাসী। শ্যামলীর বাসিন্দারা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রশীদ এখনো ভাবছেন, যেকোনো সময় ফিরে আসবে তাঁর ছোট ছেলে টিপু সুলতান। সোমবার রাতেই আজিমপুর গোরস্থানে টিপুর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তবুও বাবা বারবারই টিপুর খোঁজ করছেন, আর হেঁটে বাইরে চলে যাচ্ছেন। ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন টিপুর মা নাজমা সুলতানা। কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলাতে পারছে না।
টিপুর বড় ভাই শেখ ফরিদ গতকাল বলেন, ‘বাবা এখন একদম অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। শুধু হাঁটছেন আর নিজের মনেই কথা বলছেন।’
গতকাল প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেঁচে যাওয়া তরুণ আল আমিনের যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন শেখ ফরিদ। তিনি বলেন, ‘আল আমিন বলেছে, টিপু তাদের ফোন করে গাঁজা খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু টিপু বাসা থেকে টাকাপয়সা কিছুই নিয়ে বের হয়নি। তার মানিব্যাগটিও রেখে গেছে।’
টিপুদের বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর সড়ক পার হলেই শ্যামলী ১ নম্বর সড়কে পাশাপাশি বাসায় থাকতেন শামস রহিম শাম্মাম ও সিতাব জাবির মুনীব। গতকাল এই দুজনেরই বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্বজনেরা তাঁদের লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে গেছে।
শ্যামলীর ১ নম্বর সড়কে ১৪ বছর ধরে একটি বাসায় মা ও বোনসহ ভাড়া থাকতেন মুনীব। বাসাটির মালিক ফরিদা ইয়াসমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুনীব ডাকাত হতে পারে, এ কথা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ও আমার ছেলে জিসানের সঙ্গেই পড়ে। শবে বরাতের রাতে তারা দুজনই একসঙ্গে নামাজ পড়ে রাত ১১টার দিকে বাসায় আসে।’
জিসান বলেন, ‘রোববার রাতে আমরা দুজন একসঙ্গে এসওএস শিশুপল্লি মসজিদে নামাজ পড়ে রাত ১১টার দিকে বাসায় আসি। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে মুনীব আমাকে বলল, ও মিরপুর যাবে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। এরপর তো সকালে ওর মৃত্যু সংবাদ আসে।’
গতকাল দারুস সালামে তৌহিদুর রহমান পলাশের বাসাতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। সবাই লাশ দাফন করতে গেছে। পলাশের ফুফু বলেন, ‘পলাশের মা-বাবা সব সময়ই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে বলত। তাই বাসাতে লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল।’
কামরুজ্জামান কান্ত বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা কুসুম আক্তার তাঁকে লাল পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিয়েছিলেন। উন্মত্ত গ্রামবাসীর পিটুনিতে কান্তর সেই পাঞ্জাবি ছিঁড়ে পড়ে যায় শরীর থেকে। সোমবারও পাঞ্জাবিটা ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল, তবে গতকাল সেটি কে বা কারা ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে ফেলে।




৫:২৬ PM
Akashnill
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন