মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১১

৪১ স্কুলছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু

  • সকালের উচ্ছল কিশোরেরা বিকেলে বাড়ি ফিরেছে নিথর হয়ে। মিরসরাইয়ের সৈদালি গ্রামের স্বজনেরা এত বড় শো�
    সকালের উচ্ছল কিশোরেরা বিকেলে বাড়ি ফিরেছে নিথর হয়ে। মিরসরাইয়ের সৈদালি গ্রামের স্বজনেরা এত বড় শোক সইবেন কেমন করে!
    ছবি: প্রথম আলো
  • চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সৈদালি গ্রামে গতকাল দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাকটি উদ্ধারের চেষ্ঠা করছে গ�
    চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সৈদালি গ্রামে গতকাল দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাকটি উদ্ধারের চেষ্ঠা করছে গ্রামবাসী। পাশে স্বজনহারানো বেদনার্ত মানুষ ও উত্সুক জনতা
    ছবি: প্রথম আলো
  • চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড় তাকিয়ার আবু তোরাব সড়কে গতকাল স্কুলশিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি ট্রাক
    চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড় তাকিয়ার আবু তোরাব সড়কে গতকাল স্কুলশিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলে ৪৪ জন প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধারের চেষ্টা চালায় গ্রামবাসী
    ছবি: প্রথম আলো ও ফোকাস বাংলা
  • নিহতদের স্বজনদের আহাজারি।
    নিহতদের স্বজনদের আহাজারি।
  • উদ্ধারের পর সন্ধ্যায় সারি করে রাখা হয়েছে লাশ
    উদ্ধারের পর সন্ধ্যায় সারি করে রাখা হয়েছে লাশ
    ছবি: প্রথম আলো ও ফোকাস বাংলা
1 2 3 4 5
ফুটবল খেলা দেখে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছিল তারা। গ্রামের পথ ধরে স্কুলে পৌঁছার দেড় কিলোমিটার আগে ট্রাকটি একটি সেতু পার হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে পড়ে রাস্তার পাশে ডোবায়। এতে প্রাণ হারায় ৪৪ জন। এদের ৪১ জনই স্কুলছাত্র।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সৈদালি গ্রামে গতকাল সোমবার দুপুর পৌনে দুইটায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত ১০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তিন টন ওজনবাহী ট্রাকটিতে (চট্ট মেট্রো-ড-১১-০৩৩৭) শিশু-কিশোর মিলিয়ে ৬০-৬৫ জন ছিল। চালক নয়, সহকারী (হেলপার) ট্রাকটি চালাচ্ছিল। ট্রাকটি পানিতে পড়ার আগেই চালক লাফিয়ে নেমে পালিয়ে যায়। পুলিশ তাকে খুঁজছে।
দুর্ঘটনার পরপরই পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিকেলে আসে নৌবাহিনীর একটি ডুবুরি দল ও সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল।
এর আগেই হতাহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় বেসরকারি ক্লিনিক মাতৃকা হাসপাতাল, মস্তাননগরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশের রেকার দিয়ে পানি থেকে তোলা হয় ট্রাকটি।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রাকটি উল্টে দিয়ে ভেতরে আটকা পড়াদের উদ্ধার করে। এরই মধ্যে অনেকেই মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেও অনেকের মৃত্যু হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৩ জনের লাশ মস্তাননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় মাতৃকা হাসপাতালে ১০ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজনের লাশ শনাক্ত করা হয়। স্বজনেরা স্থানীয়ভাবে উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন ১৭ জনের লাশ। 
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নওশের আলী ঘটনাস্থলে প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে ট্রাকটি ডুবেছে, সেখানে পানির গভীরতা বেশি নয়। তবে ট্রাকটি উল্টে যাওয়ায় আরোহীরা পানির নিচে তলিয়ে যায়। ট্রাকটির চারপাশে কাঠের উঁচু ঘেরা ছিল। এ কারণে আরোহীদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। 
খবর পেয়ে ডিআইজি ছাড়াও পুলিশ সুপার জেড এ মোরশেদসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। সন্ধ্যায় আসেন মন্ত্রী ও সাংসদ।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন আয়োজিত উপজেলা পর্যায়ের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলার শেষদিন ছিল কাল। এ খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্থানীয় আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মগাদিয়া আঞ্জুমান নেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিযোগিতায় আবু তোরাব স্কুল ১-০ গোলে হেরে যায়। এ নিয়ে মাঠে সামান্য উত্তেজনাও হয়েছিল। আবু তোরাব প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দর্শক হিসেবে মাঠে এসেছিল বেশি। খেলা শেষে ফিরে যাওয়ার পথে এরাই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
গতকাল রাত আটটায় ৩৯ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় আবু তোরাব স্কুল মাঠে। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন, স্থানীয় সাংসদ মোশাররফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এরপর তাদের মরদেহ নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচজনের মরদেহ দাহ করার জন্য স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মায়ানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির নিজামী ও আবু তোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেকী জানান, মৃতদের মধ্যে আবু তোরাব স্কুলের ছাত্র ৩৫ জন, আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারজন, আবু তোরাব ফাজিল মাদ্রাসার দুজন, প্রফেসর কামাল উদ্দীন চৌধুরী কলেজের দুজন ছাত্র ও একজন অছাত্র মারা যায়।
কবির নিজামী জানান, তিনি বাদী হয়ে চালক মফিজকে আসামি করে মামলা করবেন।
নিহতদের পরিচয়: নিহত ৪৪ জনের মধ্যে ৪২ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো: মধ্যম মায়ানি গ্রামের রিয়াদ (১৪), পিতা নুরুল আফছার; জিল্লুর রহমান (১৫), পিতা মইনউদ্দিন; আরিফ (১৪), পিতা ছাদেকুল ইসলাম; তোফাজ্জল হোসেন (১৩), পিতা জহির আহমদ; তারেক (১৪), পিতা জয়নাল আবদিন; লিটন দাস, পিতা কেশব দাস; সুজন (১৩), পিতা রেদোয়ান; শামসুদ্দিন (১৪), পিতা নবী চাঁন; শরীফ (১৫), পিতা শিহাবউদ্দিন; সানি (১৪), পিতা বাহার; ইফতেখার (১৮), পিতা ফিরোজ; সাকিব (১৪), পিতা ওমর ফারুক; সুজন (১৪), পিতা জহির আহমদ; তারেক (১৪), পিতা আবুল কালাম; মঞ্জুরুল আলম (১৩), পিতা শামসুল হক; রনি (১৪), পিতা আমিরুল হক। পূর্ব মায়ানি গ্রামের সাজু (১৩), পিতা সন্তোষ; পারভেজ (১৫), পিতা ফজলুল করিম; ইমরান (১৪), পিতা আবুল কাশেম; শামসুদ্দিন (১৫), পিতা নূরুল আমিন; শাখাওয়াত হোসেন (১৪), পিতা আনোয়ার হোসেন; সাইফুল (১৩), পিতা নূরুল আলম; রাজীব ওরফে ননাই, পিতা আনোয়ার হোসেন; মইনউদ্দিন (১৩), পিতা মো. জাফর ও জাহিদুল ইসলাম (১৩), পিতা আবু জাফর। পশ্চিম মায়ানির আনোয়ার (৩০), পিতা বদিউল আলম; রুপম (১৩), পিতা ধণেশ চন্দ্র নাথ। পশ্চিম খৈয়াছড়া গ্রামের সাইফুল (১৪), পিতা কামাল উদ্দিন। সরকার টোলা গ্রামের বাসু (১৫), পিতা খোকন ও জাহিদুল ইসলাম (১৫), পিতা মীর হেসেন। শেখের তালু গ্রামের রকিবুল ইসলাম (১৫), পিতা আফতাব ও কামরুল (১৫), পিতা আলী হোসেন। কচুয়া গ্রামের মেজবাহ উদ্দিন (১৪), পিতা ফজলুল করিম; জুয়েল (১৪), পিতা হুমায়ুন করিব ও আমিন শরীফ রনি (১৫), পিতা মো. শাহজাহান। মাহান্দাবাদ মাস্টারপাড়া গ্রামের পবনাথ (১৭), পিতা বীরেন্দ্র নাথ; নূর মোহম্মদ রাহাত (১৪), পিতা কবীর মোহাম্মদ; জান্নাতুল ফেরদৌস, পিতা অজ্ঞাত ও আশরাফ (১৪), পিতা নেজাম মিস্ত্রি। দাসপাড়া গ্রামের আনন্দ দাস (১২), পিতা স্বপন দাস ও টিটু দাস (১৫), পিতা দুলাল দাস। মগাদিয়া গ্রামের শুভ (১৩), পিতা শ্রধাম; মিঠু (১৫), পিতা জগন্নাথ।
তিন দিনের শোক: এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া জানাজার সময় মন্ত্রী আফছারুল আমীন জানান, লাশ দাফনের জন্য প্রতিটি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। 
প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেকী জানান, তিন দিনের শোক কর্মসূচির মধ্যে প্রথম দিন আজ নিহতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সান্ত্বনা প্রদান, দ্বিতীয় দিন উপজেলা প্রশাসন এবং আবু তোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে শোকসভা এবং তৃতীয় দিন আবু তোরাবে শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে। আজ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এখানে আসবেন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons