রবিবার, ১৭ জুলাই, ২০১১

হাজিরা ডাকার পরই শুরু হয় কান্নার রোল

দুর্ঘটনার ছয়দিন পরে মিরসরাইয়ের আবুতোরাব স্কুল খুলেছে। সহপাঠীদের হারানোর শোক ভুলতে পারেনি শিক্ দুর্ঘটনার ছয়দিন পরে মিরসরাইয়ের আবুতোরাব স্কুল খুলেছে। সহপাঠীদের হারানোর শোক ভুলতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। কান্নায় ভেঙেপড়া শিক্ষার্থীদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক
ছবি: প্রথম আলো
মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮ ছাত্রের করুণ মৃত্যুর পর ছয় দিন কেটে গেছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক ভেবে গতকাল শনিবার আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সহপাঠী হারানোর হাহাকার যখন আবার কান্নায় রূপ নিল, তখন ক্লাস নেয় কার সাধ্য!
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলির প্রস্তুতির ঘণ্টা বাজে। সোয়া ১০টায় সব শিক্ষার্থী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একত্র হয়। সারিতে দাঁড়িয়ে চলে জাতীয় সংগীত, দোয়া ও জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ পর্যন্ত সবকিছু ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু ক্লাসে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। শ্রেণীশিক্ষক যখন হাজিরা ডাকা শুরু করেন, তখন শুরু হয় কান্নার রোল। অষ্টম শ্রেণী কান্নার উৎস। এই শ্রেণীর মেধাতালিকার প্রথম ছাত্র ধ্রুবনাথসহ ১১ জন প্রাণ হারায়। ধ্রুব পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। এবার জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (জেএসসি) তাকে নিয়ে শিক্ষকদের অনেক আশা ছিল।
দশম শ্রেণীতে হাজিরা ডাকার সময় একইভাবে কেঁদে ওঠে রাহেলা আক্তার, নিশাত, ফারজানা, সাজেদা, খালেদা, বিমল বড়ুয়া, প্রণয় চক্রবর্তী, অহিদুর রহমানেরা। সহপাঠীদের নাম ধরে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে তারা।
নবম শ্রেণীতে গিয়ে দেখা যায়, শ্রেণীশিক্ষক জাহাঙ্গীর কবির বারবার চোখের পানি মুছছেন। দেয়ালে একটি ঝুলন্ত কাগজ দেখিয়ে তিনি বলছেন, ‘এটি আমাদের নিহত ছাত্র ইমরান হোসেনের আঁকা-লেখা। ছবি-লেখা আছে, আজ সে নাই।’
এ কথা বলার পর অঝোরধারায় কাঁদতে থাকেন শিক্ষক জাহাঙ্গীর। তাঁর কান্না দেখে বাঁধভাঙা কান্না শুরু হয় পুরো কক্ষে। এভাবে প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসে কান্নার রোল।
একসময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কান্নার শব্দ পৌঁছে যায় আবুতোরাব বাজারে। ছুটে আসেন অভিভাবক, এলাকাবাসী। সান্ত্বনা দিতে এসে নিজেদের কান্না সংবরণ করতে পারেননি তাঁরাও।
পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক, সহপ্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবির চেষ্টা চালান। প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত ক্লাস শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি ভাবছেন, কখন স্বাভাবিকভাবে ক্লাস চালু করা যাবে, একমাত্র আল্লাহ জানেন।
জাফর সাদেক বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সহপাঠীদের হারিয়ে যে মানসিক কষ্ট পাচ্ছে, সেটি এখনো সংবরণ করতে পারছে না। পরিচিত শ্রেণীকক্ষে চেনা ৮-১০টি মুখ নেই, এটি ভেবেই তারা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছে। তাই বিদ্যালয় খুললেও ক্লাস নেওয়া যায়নি।
প্রধান শিক্ষক সব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের একটি বড় কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা চলে গেছে, তাদের স্মৃতি মনে রেখেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পড়ালেখায় মন দিতে হবে, দেশের জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।
প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব বিষয়ে গতকাল শনিবার বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের একটি বৈঠক হয়েছে।
আহতদের তালিকা বাড়ছে: দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের অনেক অভিভাবক আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে সাহায্যের জন্য আসছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের তৈরি করা তালিকার বাইরে থাকায় তাঁরা কোনো আর্থিক সাহায্য পাননি।
দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল, কিন্তু অনেক ছাত্র ভয়ে অভিভাবকদের জানায়নি। এখন শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তারা অভিভাবককে বলছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের অভিভাবকেরা এখন সাহায্যের জন্য আসছেন।
গতকাল বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রাসুল করিম প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেকের অফিসে এসে জানায়, ওই দিন সে দর্ঘটনায় আহত হয়েছিল। সে পারিবারিকভাবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিল। এখন শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট পাচ্ছে, কষ্ট আস্তে আস্তে বাড়ছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র মো. নিজাম উদ্দীন এখন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তার মা বিবি জোহরা জানান, নিজাম এখন মাঝে মাঝে বমি করছে।
জানা গেছে, ওই দিন সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দীনসহ আহত হয়েছে আরও ১০ জন। জেলা প্রশাসনের তালিকায় নাম না থাকায় এরা সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পায়নি।
১১ জনকে ছাড়পত্র: চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন ১৬ জনের মধ্যে ১১ জনকে কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দিয়েছে। মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কবির নিজামী জানান, আহত শিক্ষার্থীরা এলাকায় ফিরে এসেছে। এখন তাদের অভিভাবকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ফিরে আসা ১১ জন হচ্ছে মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র জাবেদুল ইসলাম; আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর আশিক রিজভী হূদয়; সপ্তম শ্রেণীর রায়হান উদ্দীন, বোরহান উদ্দীন, আরিফ হোসেন; অষ্টম শ্রেণীর জুয়েল বড়ুয়া, মেহেদি হাসান, মো. মামুন; নবম শ্রেণীর মোতাহার হোসেন; কৃষক মো. আলমগীর এবং প্রফেসর কামাল উদ্দীন চৌধুরী কলেজের নৈশপ্রহরী মো. আবুল কাশেম।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons