মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার আতিয়াবাগ চা-বাগানে বেশকিছু দিন ধরে পরিপূর্ণ গাছকর্তনের নামে অবাধে ছোট আকারের গাছকর্তন চলছে। গতকাল দুপুরে ছবিটি তুলেছেন কল্যাণ প্রসূনউপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আতিয়াবাগ চা-বাগান ধামাই টি এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন। কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। জুড়ীর পশ্চিম জুড়ী ও পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নে আতিয়াবাগসহ পাশাপাশি ধামাই ও সোনারুপা নামের ওই প্রতিষ্ঠানের আরও দুটি চা-বাগান আছে।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ১১ ডিসেম্বর আতিয়াবাগ চা-বাগানের সাবেক ব্যবস্থাপক গোপাল কুমার সিকদার (বর্তমানে ধামাইয়ের ব্যবস্থাপক) চায়ের আবাদ সম্প্রসারণের কারণ উল্লেখ করে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কেনা প্রায় ৫৩ একর জায়গা (ইজারাবহির্ভূত) থেকে পরিপক্ব বিভিন্ন জাতের বনজ দুই হাজার ৫২০টি গাছ কাটার অনুমতি পেতে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের গত ২৫ এপ্রিল সিলেটের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. দেলোয়ার হোসেন উল্লিখিত জায়গা থেকে দুই হাজার ৩২টি গাছ কাটতে বাগানের ব্যবস্থাপককে লিখিত অনুমতি দেন।
অনুমতিপত্রের শর্তে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মনোনীত প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চিহ্নিত (মার্কিং) করা গাছ কর্তন ও স্থানান্তর করতে হবে। চিহ্নিত তালিকা অনুযায়ী তিন ফুট বেড়ের কম পরিমাপের ৪৮৮টি গাছ কাটা যাবে না। কাটার পর গোড়ায় গাছ থাকা অবস্থায় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ‘পাস মার্কা’ করতে হবে।
সূত্র জানায়, পরে বাগান কর্তৃপক্ষ প্রায় এক কোটি টাকায় ওই গাছগুলো শ্রীমঙ্গলের কাঠ ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর কাছে বিক্রি করে দেয়। কিবরিয়ার নিয়োজিত শ্রমিকেরা মাস দু-এক ধরে সেখানে গাছ কাটছেন।
গত সোমবার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চা-বাগানের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে গর্জন, কড়ই, একাশিয়া, চাপালিশসহ বিভিন্ন জাতের গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অনুমতিপত্রে উল্লিখিত তিন ফুট বেড়ের চেয়ে কম মাপের গাছও আছে। কাটা গাছের কোনোটিরই গোড়ায় বন বিভাগের পাস মার্কা নেই। স্থানীয় একটি ডিপোতে কয়েক হাজার গাছের টুকরা স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব ফাঁকি দিতে অনুমতিপত্রের আড়ালে এ কাজটি হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মুমিত, ইউএনও মনীষ চাকমা, জুড়ী-১ রেঞ্জের বন কর্মকর্তা আবদুস সাত্তারসহ ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা গত শনিবার (১৫ জুলাই) এবং সোমবার (১৮ জুলাই) আতিয়াবাগে গিয়ে গাছ কাটা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
ইউএনও মনীষ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমতিপত্রে যে এলাকা থেকে গাছ কাটার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ৫০০টির বেশি পরিপক্ব গাছ নেই। ইজারাভুক্ত অংশ থেকে অবৈধভাবে বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটা ও পরিবহন বন্ধ করতে বাগান কর্তৃপক্ষ ও কাঠ ব্যবসায়ীর লোকজনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বরাবর তিনি একটি প্রতিবেদন পাঠাবেন।
তিনি জানান, গাছ কাটার সময় জেলা প্রশাসকের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তাঁকে কিছুই জানায়নি।
আতিয়াবাগ চা-বাগানের বর্তমান ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, গাছ কাটার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে। তিনি বন বিভাগের অনুমতিসংক্রান্ত চিঠি পাননি। সেটি না পাওয়ায় কোন কোন এলাকা থেকে গাছ কাটা হবে, সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানতে পারেননি।
তাঁর ভাষ্যমতে, মাস দু-এক আগে গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বাগানে এসে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে তাঁকে মুঠোফোনে আলাপ করান। এমডির নির্দেশে তিনি তাঁকে গাছ কাটানোর অনুমতি দেন।
জুড়ী-১ রেঞ্জের বন কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার গত মঙ্গলবার বলেন, আতিয়াবাগের কাটার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত দুই হাজার ৩২টি গাছ চিহ্নিত (মার্কিং) করা হয়েছে বছর দু-এক আগে। তখন অন্য কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। অবৈধভাবে কাটা গাছগুলো জব্দ করা হচ্ছে। কাটা গাছের গোড়ায় পাস মার্কা না দেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, সেগুলোও অবৈধভাবে কাটা হয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন অথবা সরকারি জায়গা থেকে গাছ কাটার ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়।
কাঠ ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী মুঠোফোনে দাবি করেন, ইজারাভুক্ত অংশ থেকে কোনো গাছ কাটা হয়নি। প্রায় ৪০ শতাংশ গাছ কাটার কাজ শেষ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন।
ধামাই টি এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাফিয়া আসাফ আলী মুঠোফোনে বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই গাছ কাটা হচ্ছে বলে তিনি জানেন। ইজারাভুক্ত অংশ থেকে গাছ কাটার বিষয়টি তিনি ব্যবস্থাপককে দিয়ে খোঁঁজ নিয়ে দেখবেন।
সিলেটের ডিএফও মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাগান ব্যবস্থাপক কেন অনুমতিপত্র পাননি, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। আর গাছ কাটার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টি তিনি জেনেছেন। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তিনি জানান, ইজারাভুক্ত অংশ থেকে গাছ কাটলে সরকারের কোষাগারে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব দিতে হয়।




১০:৩৫ AM
Akashnill
Posted in:
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন