বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১১

ক্যানসারের চিকিৎসার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রতারণা

ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কার করার দাবি তাঁর। এ রোগের চিকিৎসাও দেন তিনি। সুস্থ করার আশ্বাস দিয়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা নিচ্ছেন। তবে এ পর্যন্ত কোনো রোগীকে সুস্থ করতে পারেননি। রোগীপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছে।
এই অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাইজিদ আলম শিবিবের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে প্রতারিত একটি পরিবার। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে প্রতারণার আরও ঘটনা পাওয়া গেছে।
বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, শিবিবের দাবি যে তিনি আধ্যাত্মিকভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা করেন। তিনি পীর বংশের সন্তান। তাঁর মৃত চাচা স্বপ্নে এ চিকিৎসা শিখিয়েছেন।
শিবিবের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়। ১৯৯০ সালে প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ছয় বছর আগে নিজেকে ক্যানসারের প্রথম চিকিৎসক বলে দাবি করতে থাকেন। একটি পত্রিকা এ বিষয়ে তাঁর সাক্ষাৎকারও ছাপে।
শিবিব প্রথম আলোকে জানান, ২০০৫ সালে ইঁদুরের ওপর ওষুধের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, মানুষের ওপর কোনো পরীক্ষা করেননি। তিনি প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চিকিৎসা নিয়েছেন, এমন পাঁচটি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রোগীপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক মাসের মধ্যে রোগী সুস্থ হবে—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিবিব চিকিৎসা শুরু করেন। দাবি করেন পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা। অর্থ লেনদেনের কাগজ রোগীপক্ষকে দেন না। বলেন, চিকিৎসার সময় রোগীর স্বজন উপস্থিত থাকতে পারবে না। এসব শর্তে রাজি হলে আধ্যাত্মিক চিকিৎসার নামে রোগীর চোখ বাঁধেন। নিজের আবিষ্কৃত ওষুধ খাওয়ান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় সহজেই শিবিবের কথায় অনেকে বিশ্বাস করেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল কৌশরী জানান, তাঁর বাবা রফিকুল ইসলাম অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৮ সালে তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। ভারতে এবং ঢাকায় শুরু হয় চিকিৎসা। একদিন অগ্রণী ব্যাংকেরই এক কর্মকর্তা শিবিবের চিকিৎসার বিষয়ে জানান। দেখা করলে শিবিব বলেন, এক মাসের মধ্যে সুস্থ করে দেবেন। নগদ সাড়ে সাত লাখ টাকা চান তিনি।
কৌশরী বলেন, ‘এত টাকা শুনে আমরা প্রথমে রাজি হইনি। শিবিব বারবার বলতে থাকেন, সুস্থ না হলে টাকা ফেরত দেবেন।’ ২০০৮ সালের ২৮ মে থেকে শুরু হয় চিকিৎসা।
এক মাস পর শিবিব বলেন, ক্যানসার জটিল হয়েছে। আরও এক মাস ওষুধ খাওয়াতে হবে। চান আরও সাড়ে সাত লাখ টাকা। কৌশরী বলেন, ‘এ অবস্থায় আমরা জমি বিক্রি করে, ব্যাংকের কাছে বাড়ি বন্ধক রেখে এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে সাড়ে সাত লাখ টাকা দিই। দুই মাস চিকিৎসার পর শিবিব দাবি করেন, রোগী সুস্থ হয়ে গেছে।’ কিন্তু ল্যাবএইড ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারেন, ক্যানসার আছেই। শিবিব বলেন, ওসব পরীক্ষা ভুল। তিনি ১৫ দিন চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে আরও তিন লাখ টাকা চান। এভাবে রোগীপক্ষ ১৮ লাখ টাকা দিয়েছে শিবিবকে। শিবিব চিকিৎসা ও পরীক্ষার সব কাগজ নিজের কাছে রেখে দেন।
কৌশরী জানান, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বাবা গুরুতর অসুস্থ হলে কাগজপত্র আনতে শিবিবের কাছে যান। কাগজপত্র ফেরত না দিয়ে তিনি আবারও চিকিৎসা দিতে চান এবং বাড়তি টাকা চান। ‘একরকম বাধ্য হই আমরা,’ বলেন কৌশরী। ১৬ ফেব্রুয়ারি শিবিব ওই রোগীকে ইনজেকশন ও কিছু ওষুধ দেন। রোগীর পেট ফুলে যায়। শিবিব বেলের শরবত, স্যালাইন ও ইসবগুলের ভুসি খাওয়াতে বলেন। অবস্থার অবনতি হলে রোগীকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতাল এবং পরে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি কৌশরীর বাবা মারা যান। পুরো ঘটনা তিনি লিখিতভাবে উপাচার্যকে জানিয়েছেন।
কৌশরীর মতোই প্রতারণার শিকার বরিশাল বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী উম্মে মমতা বিল্লাহ। মমতা প্রথম আলোকে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মাধ্যমে জানতে পেরে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ বাবার চিকিৎসার জন্য শিবিবের কাছে যান। সাত লাখ টাকা দাবি করে শিবিব বলেন, এক মাসে রোগী সুস্থ হবে। চোখ বেঁধে ওষুধ খাওয়ানো শুরু করেন। নির্ধারিত সময় মমতার বাবা সুস্থ না হলে শিবিব বাড়তি টাকা দাবি করেন। এভাবে ১১ লাখ টাকা নেন। মাস দুয়েক পরই মমতার বাবা মারা যান। মমতা বলেন, ‘আমি এই প্রতারকের বিচার চাই।’
সহকর্মী জেবা ইসলাম মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসা করান শিবিবের কাছে। চিকিৎসা নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে মারা যান জেবার মা। জেবা প্রথম আলোকে জানান, চায়ের মতো একধরনের তরল পানীয় রোগীকে খাওয়াতেন শিবিব। নিজের বাসায় সম্পূর্ণ পৃথক একটি কক্ষে শিবিব এই তরল পানীয়ের মিশ্রণ তৈরি করতেন। ওষুধ খাওয়ানোর সময় শিবিবের শরীর থেকে ঘাম ঝরতে দেখা গেছে।
ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আফরোজা সুলতানার স্বামী মো. নূর ইসলাম ছিলেন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। ২০০৮ সালের অক্টোবরে নূর ইসলামের ক্যানসার ধরা পড়ে। ভারত এবং দেশের দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর শিবিবের কাছে যান তিনি।
আফরোজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন লাখ টাকা নিয়ে এক মাস ওষুধ খাওয়াবেন, এমন কথা বলে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু ১০ দিন পরই তিনি অতিরিক্ত টাকা চাওয়া শুরু করেন। ২০ দিনের মধ্যে সাত লাখ টাকা নেন। অবস্থার উন্নতি হওয়ার বদলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’ আফরোজা বলেন, তিনিও প্রতারণার বিচার চান।
ক্যানসারের চিকিৎসার নামে প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে শিবিব সব ঘটনা অস্বীকার করেছেন। প্রত্যেক রোগীর নাম ধরে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো কারও চিকিৎসা করিনি। এ ছাড়া আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, এমন দলিলও কেউ দেখাতে পারবে না।’ এমনকি বিভাগের সহকর্মী জেবা ইসলামের মায়ের চিকিৎসাও করেননি বলে দাবি করেছেন তিনি।
আনোয়ার হোসেনও নিকটাত্মীয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন শিবিবকে দিয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিবিবের চিকিৎসায় কেউ ভালো হয়েছেন, এমন শুনিনি।’
যোগাযোগ করা হলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে।
আহমেদ জায়িফ
Prothom-alo.com

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons